এই অধ্যায়ের শেষে শিক্ষার্থীরা নিম্নোক্ত বিষয়গুলো শিখতে পারবে—
পৃথিবীর এই যে বিচিত্র জীবজগৎ, তা টিকে থাকার জন্য দরকার হয় শক্তির। এই শক্তি কোথা থেকে আসে জানো? পৃথিবীর সব শক্তি আসে সূর্য থেকে। যে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সূর্যের আলোকরশ্মি পৃথিবীর অসংখ্য জীবকে টিকিয়ে রাখতে, তাদের শক্তি যোগাতে সাহায্য করে তার নাম সালোকসংশ্লেষণ বা Photosynthesis। পৃথিবীর জীবজগতের জন্য সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া অশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমেই সূর্যের আলোকশক্তি রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে বড় বড় জৈব অণুর মধ্যে, বিশেষ করে কার্বোহাড্রেট বা শর্করা হিসেবে জীবের কোষের মধ্যে জমা হয়।
কিন্তু শক্তি তো শুধু জমা করলেই হবে না, জীবের নানান কাজে সেই শক্তিকে ব্যবহারও করতে হবে। এই উদ্দেশ্যে শর্করা (Carbohydrate) ভেঙে কোষের বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করার উপযোগী শক্তিরূপে পরিণত করে আরেকটি প্রক্রিয়া। এর নাম শ্বসন (Respiration)।
প্রকৃতিগত দিক থেকে সালোকসংশ্লেষণ এবং শ্বসন প্রায় বিপরীতমুখী প্রক্রিয়া। কারণ, একটিতে শক্তি সঞ্চিত হয়, আরেকটিকে সঞ্চিত শক্তি ভেঙে কোষের ব্যবহার উপযোগী রূপে নেওয়া হয়। তবে মনে রাখতে হবে, সালোকসংশ্লেষণ ও শ্বসন প্রক্রিয়ার বিক্রিয়াগুলো হুবহু বিপরীত কিছু নয়। সালোকসংশ্লেষণ এবং শ্বসন প্রক্রিয়া দুটি তুলনা করলে পৃথিবীতে সমস্ত জীব যে সংযুক্ত সেটা বোঝা যায়। সালোকসংশ্লেষণে অংশ নেওয়া উপকরণগুলো শ্বসনের কাঁচামাল, আর শ্বসন প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত উপাদান ব্যবহৃত হয় সালোকসংশ্লেষণে। উভয় প্রক্রিয়ায় সাধারণভাবে যে পদার্থগুলো অংশগ্রহণ করে থাকে, সেগুলো হলো কার্বন, হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন।
বিজ্ঞানীদের দীর্ঘদিনের গবেষণায় এই দুটো প্রক্রিয়া আবিষ্কৃত হয়েছে, এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত একাধিক বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তাদের মধ্যে মেলভিন কেলভিন, রবার্ট হুবার, হ্যান্স ক্রেবস, অটো ওয়ারবার্গ প্রমুখ বিজ্ঞানীর নাম উল্লেখযোগ্য।
সালোকসংশ্লেষণ শব্দটিকে যদি আমরা ভাঙি, তবে পাওয়া যায়: স+আলোক+সংশ্লেষণ। সংশ্লেষণ শব্দটির অর্থ তৈরি করা বা হওয়া। তার মানে, আলোর উপস্থিতিতে যে সংশ্লেষণ হয়, তাকেই আমরা সালোকসংশ্লেষণ বলতে পারি। ইংরেজিতেও কিন্তু বিষয়টা এমনই বুঝায়। সালোকসংশ্লেষণ এর ইংরেজি প্রতিশব্দ Photosynthesis শব্দটি দুটি গ্রিক শব্দ photos (অর্থ: আলোক; এখানে সূর্যালোক) ও synthesis (অর্থ: সংশ্লেষণ বা তৈরি করা) এর সমন্বয়ে গঠিত। এক কথায় বলা যায়, সালোকসংশ্লেষণ বা Photosynthesis- এর অর্থ: সূর্যালোকের উপস্থিতিতে রাসায়নিক সংশ্লেষণ।
কী ঘটে এ সময়ে? কোন কোন রাসায়নিক উপাদান বা কাঁচামাল অংশ নেয় কিংবা তৈরি হয় এই প্রক্রিয়ায়? কোথায় সংঘটিত হয় জীবজগতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রক্রিয়া? নিচের আলোচনায় আমরা এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করব।
সালোকসংশ্লেষণ হচ্ছে একটি জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া যা সবুজ উদ্ভিদ এবং কিছু বিশেষ অণুজীবের (যেমন: সবুজ শৈবাল, সায়ানোব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি) কোষে সংঘটিত হয়। প্রক্রিয়াটিকে নিম্নলিখিত কয়েক ধাপে সম্পন্ন হয় :
১. বাতাস থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO2) উদ্ভিদের পাতায় প্রবেশ করে;
২. উদ্ভিদের মূল দ্বারা শোষিত পানি পরিবাহিত হয়ে পাতায় পৌঁছায়;
৩. পাতার কোষের বিশেষ অঙ্গাণু ক্লোরোপ্লাস্টে সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে, CO, ও পানির মধ্যে বিক্রিয়া হয় এবং জটিল কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা জাতীয় অণু তৈরি হয়। এই প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন প্রকৃতিতে নির্গত হয় ।
সুতরাং পুরো বিষয়টিকে এভাবে বলা যায়- সূর্যের শক্তি ব্যবহার করে কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO2) এবং পানির মধ্যে বিক্রিয়ায় শর্করা ও অক্সিজেন তৈরির প্রক্রিয়াটিই সালোকসংশ্লেষণ। খুব ছোট সহজ একটি বিক্রিয়ার মাধ্যমে পুরো প্রক্রিয়াটি দেখানো যায়,
এখানে ডান পাশে দ্বারা কার্বহাইড্রেটকে বুঝানো হয়েছে।
সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় যে অক্সিজেন উৎপন্ন হয় সেটি খুব সহজ একটি পরীক্ষণ বা experiment-এর মাধ্যমে দেখানো যায়।
পরীক্ষার উপকরণ: একটা বিকার, একটা ফানেল, একটা টেস্টটিউব, পানি, সতেজ জলজ উদ্ভিদ হাইড্রিলা ও একটা দিয়াশলাই।
পরীক্ষণ পদ্ধতি: বিকারটির দুই-তৃতীয়াংশ পানি দিয়ে পূর্ণ করি। সতেজ হাইড্রিলা উদ্ভিদগুলো বিকারে পানিতে রেখে ফানেল দিয়ে এমনভাবে ঢেকে দিই যেন হাইড্রিলা উদ্ভিদগুলোর কাণ্ড ফানেলের নলের উপরের দিকে থাকে। এরপর বিকারে আরও পানি ঢালি যেন ফানেলের নলটা সম্পূর্ণভাবে পানিতে ডুবে যায়। এবার টেস্টটিউবটা পানি দিয়ে পূর্ণ করে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে বন্ধ করে ফানেলের নলের উপর এমনভাবে উল্টিয়ে দিই, যেন টেস্টটিউবের পানি বের না হয়ে যায়। এরপর সব কিছুকে সূর্যালোকে রাখি। কিছুক্ষণ পর দেখতে পাবে হাইড্রিলা উদ্ভিদগুলোর কাণ্ডের প্রান্ত দিয়ে বুদবুদ আকারে গ্যাস বের হয়ে টেস্টটিউবে জমা হচ্ছে এবং টেস্টটিউবের পানি নিচে নেমে যাচ্ছে। টেস্টটিউবটা প্রায় সম্পূর্ণটা গ্যাসে পূর্ণ হলে, দিয়াশলাইয়ের একটা সদ্য নিভন্ত কাঠি টেস্টটিউবের মুখে প্রবেশ করলে, নিভন্ত কাঠিটি দপ করে জ্বলে উঠবে। দিয়াশলাইয়ের কাঠিটা কেন দপ করে জ্বলে উঠবে?
আমরা জানি অক্সিজেন এমন একটি গ্যাস যেটি দাহ্য কোনো পদার্থের স্পর্শে এলে তাকে জ্বালিয়ে দেয়। উপরের পরীক্ষায় দিয়াশলাইটি জ্বলে উঠেছে, যা প্রমাণ করে যে বিকারে উৎপন্ন গ্যাসটি হচ্ছে অক্সিজেন।
সূর্যের আলোর শক্তিকে জৈব রাসায়নিক শক্তিতে পরিণত করতে পারে এমন জীবে সালোকসংশ্লেষণ হয়। এই তালিকায় কিছু ব্যাকটেরিয়া এবং শৈবালও আছে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে উদ্ভিদের সবুজ পাতা, যেখানে সালোকসংশ্লেষণের সবচেয়ে আদর্শ অবস্থাটি পাওয়া যায়। আমরা এখানে কেবল উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণের কথাই আলোচনা করব।
চারপাশে তাকালে আমরা যেসব উদ্ভিদ দেখতে পাই, সেগুলোর প্রায় অধিকাংশেরই সবুজ পাতা থাকে। চারপাশে অন্য রঙের পাতাও থাকতে পারে। পাতা হচ্ছে, উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণের প্রধান অঙ্গ। পাতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর পৃষ্ঠে ছোট ছোট ছিদ্র থাকে, যা দিয়ে বাতাস থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড পাতার কোষের ভেতর প্রবেশ করতে পারে। এই ছোট ছোট ছিদ্রকে পত্ররন্ধ্র (stomata) বলে। পত্ররন্ধ্রগুলো এক ধরনের বিশেষ কোষ দ্বারা সুরক্ষিত থাকে। এসব কোষকে বলা হয় গার্ড সেল (Guard cell) বা রক্ষক কোষ।
গাছের পাতা সবুজ হয় কেন জানো? কারণ, পাতার কোষে ক্লোরোফিল (Chlorophyll) নামক এক ধরনের সবুজ কণিকা থাকে। ক্লোরোফিলের উপস্থিতিই পাতার সবুজ রঙের জন্য দায়ী। এই ক্লোরোফিল কণা কিন্তু কোষের ভেতরে ছড়িয়ে- ছিটিয়ে থাকে না। বরং উদ্ভিদ কোষের ক্লোরোপ্লাস্ট (Chloroplast) নামক একটি বিশেষ অঙ্গাণুর মধ্যে অবস্থান করে। ক্লোরোপ্লাস্টের গঠন বৈশিষ্ট্য এমন যে, এর ভেতরে বিশেষভাবে ভাঁজ হয়ে থাকা দুই স্তরবিশিষ্ট ঝিল্লি (Membrane) রয়েছে। এই ঝিল্লির গায়েই ক্লোরোফিল অণুগুলো নির্দিষ্ট অবস্থানে সজ্জিত থাকে। এই ক্লোরোপ্লাস্ট-এর উপস্থিতি হচ্ছে উদ্ভিদ কোষের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। প্রাণী কোষে কিন্তু ক্লোরোপ্লাস্ট থাকে না। ক্লোরোফিলসমৃদ্ধ সবুজ পাতাই উদ্ভিদের প্রধান সালোকসংশ্লেষকারী অঙ্গ। তবে পাতা ছাড়াও যে কোনো সবুজ সজীব কোষে অর্থাৎ সবুজ কাণ্ডে (ফণীমনসা, লাউ, কুমড়া, পুঁই ইত্যাদি), ফুলের সবুজ বৃতিতে, অর্কিড মূলের সবুজ অংশে সালোকসংশ্লেষণ হতে পারে।
সালোকসংশ্লেষণের গুরুত্ব
সালোকসংশ্লেষণ হলো উদ্ভিদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদ খাদ্য উৎপাদন করে। জীবজগতে সালোকসংশ্লেষণের গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্নে সংক্ষেপে এর গুরুত্ব আলোচনা করা হলো:
১. পৃথিবীর শক্তির উৎস সূর্য থেকে উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় সৌরশক্তিকে রাসায়নিক শক্তিতে পরিণত করে।
২. খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে উক্ত শক্তি সকল জীবে সঞ্চারিত হয়।
৩. পৃথিবীর সকল উদ্ভিদ ও প্রাণীর খাদ্য প্রস্তুত হয় সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায়।
৪. পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় CO, ও O, অনুপাত ঠিক রাখতে সালোকসংশ্লেষণ বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
৫. মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় বিভিন্ন উপাদান যেমন কয়লা, পেট্রোল, রেয়ন, কাগজ, রাবার, ওষুধ ইত্যাদি সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার ফল।
প্রতিটি জীবদেহে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের জৈবনিক প্রক্রিয়ার জন্য শক্তি প্রয়োজন। এই শক্তি কিন্তু আসে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় সূর্যের আলো থেকে। আমাদের খাবারের মধ্যে থাকা শর্করা, প্রোটিন ও লিপিড অণুতে শক্তি সঞ্চিত থাকে। শরীরে অক্সিজেনের উপস্থিতিতে খাদ্যের মধ্যে থাকা এই শক্তিকে গতিশক্তি ও তাপশক্তিতে রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়া হচ্ছে শ্বসন। এই গতিশক্তি ও তাপশক্তির দ্বারা জীব খাদ্য গ্রহণ, চলন, রেচন, বৃদ্ধি, জনন প্রভৃতি শারীরবৃত্তীয় কাজ সম্পন্ন করে থাকে।
শ্বসন একটি বিপাকীয় ক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া চলাকালে বেশিরভাগ জীব পরিবেশ থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করে। তবে সরল শ্রেণির কিছু উদ্ভিদ ও প্রাণী অক্সিজেন ছাড়া শ্বসনক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে। অক্সিজেনের উপস্থিতিতে যে শ্বসন সম্পন্ন হয়, তাকে সবাত শ্বসন (Aerobic respiration) বলে। অপরদিকে অক্সিজেনের অনুপস্থিতে সম্পন্ন শ্বসন প্রক্রিয়াকে অবাত শ্বসন (Anaerobic respiration) বলে।
উভয় প্রকার শ্বসনের ক্ষেত্রেই কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপন্ন হয়। উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রতিটি সজীব কোষে দিন রাত সব সময় শ্বসন কার্য ঘটে চলে। আমরা মানুষ যে অক্সিজেন ছাড়া বাঁচতে পারি না, তার মূল কারণ আমাদের শক্তি উৎপাদন অক্সিজেন ছাড়া সম্ভব নয়। অক্সিজেনের উপস্থিতিতে আমাদের গ্রহণ করা খাবার জারিত (খাবারের রাসায়নিক উপাদানের সঙ্গে অক্সিজেনের বিক্রিয়া) হয়ে শক্তি উৎপন্ন হয় এবং একই সঙ্গে কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত হয়।
উপরের আলোচনা থেকে বলা যায়, যে জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জীবকোষে থাকা খাদ্যবস্তু অক্সিজেনের উপস্থিতি (বা অনুপস্থিতিতে) জারিত হয়ে খাদ্যে থাকা রাসায়নিক শক্তিকে গতিশক্তি ও তাপশক্তিতে রূপান্তরিত ও মুক্ত করে। ফলশ্রুতিতে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও পানি উৎপন্ন হয় তাকে শ্বসন বলে।
উদ্ভিদ ও প্রাণীদেহের বিভিন্ন সজীব কোষে শ্বসন প্রক্রিয়াটি মূলত একই। কিন্তু বিভিন্ন জীবের অক্সিজেন গ্রহণ ও কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমন পদ্ধতিটি ভিন্নরূপ। উদ্ভিদ দেহে শ্বসনকালে অক্সিজেন ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের বিনিময় প্রক্রিয়াটি অপেক্ষাকৃত সরল। উদ্ভিদের কোনো নির্দিষ্ট শ্বসন অঙ্গ নেই। পাতার পত্ররন্ধ্র, কাণ্ডের ছিদ্রপথ এবং অন্তঃকোষের মাধ্যমে বায়ু উদ্ভিদ দেহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।
প্রাণীর দেহেও শ্বসন, বিভিন্ন অঙ্গের মাধ্যমে নানাভাবে সম্পন্ন হয়। সরল প্রাণীতে প্রধানত ত্বক ও শ্বাসনালির মাধ্যমে শ্বসন হয়। উন্নত প্রাণীর শ্বসনে অক্সিজেন ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের বিনিময়ের জন্য বিশেষ ধরনের শ্বসন অঙ্গ আছে। যেমন মাছ ও ব্যাঙাচি ফুলকার সাহায্যে এবং স্থলজ মেরুদণ্ডী প্রাণী ফুসফুসের সাহায্যে শ্বসন সম্পন্ন করে।
শ্বসনকালে শক্তি উৎপন্ন হওয়ার প্রমাণ শ্বসনে যে শক্তি উৎপন্ন হয়, তা পরের পৃষ্ঠায় বর্ণিত পরীক্ষার দ্বারা প্রমাণ করা যায়।
পরীক্ষার উপকরণ: দুটি থার্মোফ্লাস্ক, দুটি থার্মোমিটার, অঙ্কুরিত ছোলাবীজ, পানিতে সিদ্ধ ছোলাবীজ ও ছিদ্রযুক্ত রাবারের ছিপি।
পরীক্ষণ পদ্ধতি: অঙ্কুরিত ছোলাবীজগুলাকে একটি থার্মোফ্লাক্সের মধ্যে রেখে একটি ছিদ্রযুক্ত ছিপি দিয়ে মুখটি বন্ধ করতে হবে। এরপর ছিপির ছিদ্রের মধ্য দিয়ে একটি থার্মোমিটার এমনভাবে প্রবেশ করতে হবে, যেন থার্মোমিটারের নিচের প্রান্তটি অঙ্কুরিত ছোলাবীজগুলোর মধ্যে প্রবেশ করে থাকে। অনুরূপভাবে অপর থার্মোফ্লাস্কটিতে সিদ্ধ ছোলাবীজগুলোকে রাখতে হবে এবং অপর থার্মোমিটারটি স্থাপন করতে হবে। প্রতিটি থার্মোমিটারের পারদ তাপমাত্রার অবস্থান চিহ্নিত করে রাখতে হবে।
থার্মোমিটার পর্যবেক্ষণ:
কিছুক্ষণ পর দেখা যাবে জীবন্ত অঙ্কুরিত ছোলাবীজযুক্ত থার্মোফ্লাস্কের উষ্ণতার বৃদ্ধি ঘটায় থার্মোমিটারের তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটেছে। সিদ্ধ বীজযুক্ত থার্মোফ্লাস্কের উষ্ণতার বৃদ্ধি হয়নি অর্থাৎ এই থার্মোফ্লাস্কে রাখা থার্মোমিটারের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত আছে।
সিদ্ধ ছোলাগুলোর কোষগুলো জীবিত নয়। ফলে সেখানে শ্বসন প্রক্রিয়া চলছে না। অপরদিকে জীবিত ছোলাগুলোতে জীবন্ত কোষে শ্বসন প্রক্রিয়া চলছে। সেখানে উৎপন্ন তাপশক্তি তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, জীবন্ত কোষে শ্বসন প্রক্রিয়ার ফলে তাপশক্তি উৎপন্ন হয়।
তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ যে, শীতকালে যখন আমাদের নাক ও মুখ থেকে শ্বাস ছেড়ে দেই, তখন আমরা হালকা ধোঁয়ার মতো বাতাস বের হতে দেখি। আমরা যখন শ্বাস ছাড়ি তার সাথে আমাদের ফুসফুস থেকে জলীয় বাষ্প যোগ হয়। শীতের সময়ে এই শ্বাসের সাথে বের হয়ে আসা জলীয় বাষ্প বাইরের কম তাপমাত্রায় ছোট ছোট পানির কনায় পরিণত হয়, যা আমরা ধোঁয়ার মতো দেখি। আমরা সাধারণত নাক দিয়ে বাতাস নিই, আবার ছেড়ে দিই। আমাদের বুক হাঁপরের মতো অবিরত সংকুচিত ও প্রসারিত হয়। এতে ফুসফুসের আয়তন বাড়ে ও কমে৷ বুকে হাত দিলেই বিষয়টি টের পাবে। গভীরভাবে শ্বাস নাও আবার ছেড়ে দাও। এটিই মূলত তোমার শ্বসন প্রক্রিয়ার একটি দৃশ্যমান ধাপ। তবে কোষের ভেতরে সংঘটিত শ্বসন প্রক্রিয়ার অংশটুকু কিন্তু আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। কেবল পরীক্ষণের মাধ্যমে আমরা তা বুঝতে পারি।
ফুসফুস অবিরত সংকুচিত ও প্রসারিত হয়ে অক্সিজেন গ্রহণ ও কার্বন ডাইঅক্সাইড পরিত্যাগ করে। এভাবে অবিরত অক্সিজেন নেওয়া ও কার্বন ডাইঅক্সাইড পরিত্যাগ করা শ্বাসক্রিয়া নামে পরিচিত। এটা শ্বসনের একটি ধাপ। শ্বসন প্রক্রিয়াকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যথা ১. বহিঃশ্বসন ও ২. অন্তঃশ্বসন।
১. বহিঃশ্বসন: যে প্রক্রিয়ায় ফুসফুসের মধ্যে গ্যাসীয় আদান-প্রদান ঘটে, তাকে বহিঃশ্বসন বলে৷ এ পর্যায়ে ফুসফুস ও রক্তের মধ্যে অক্সিজেন ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের বিনিময় ঘটে। বহিঃশ্বসন দুই পর্যায়ে সম্পন্ন হয়। যথা (i) প্রশ্বাস বা শ্বাস গ্রহণ: পরিবেশ থেকে আমরা যে অক্সিজেনযুক্ত বায়ু গ্রহণ করি, একে শ্বাস গ্রহণ বা প্রশ্বাস বলে। (ii) নিশ্বাস: প্রশ্বাসের পর পরই নিঃশ্বাস পর্যায় শুরু হয়। এ পর্যায়ে আমাদের ফুসফুস আয়তনে ছোট ও সংকুচিত হয়। ফলে বায়ুথলির ভিতরের বায়ু, কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস ফুসফুস থেকে পরিবাহিত হয়ে নাক দিয়ে বাইরে নির্গত হয়।
২. অন্তঃশ্বসন: অন্তঃশ্বসন প্রক্রিয়ায় দেহের কোষের মধ্যকার খাদ্য অক্সিজেনের সাহায্যে জারিত (Oxidized) হয়ে গতিশক্তি ও তাপশক্তিতে পরিণত হয়। ফুসফুসের রক্তে যে অক্সিজেন প্রবেশ করে, তা রক্তের মাধ্যমে বাহিত হয়ে প্রতিটি কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। তারপর এটি কোষের ভিতরের খাদ্যের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে শক্তি উৎপন্ন করে। এর ফলে তাপশক্তি ও কার্বন ডাইঅক্সাইড তৈরি হয়। এই কার্বন ডাইঅক্সাইড আবার রক্ত দ্বারা বাহিত হয়ে ফুসফুসে ফেরত আসে।
শ্বসনের গুরুত্ব
শ্বসন প্রক্রিয়াটি জীবের শক্তি ব্যবহারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ৷ প্রতিটি জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়া সচল রাখার জন্য একটি জীবের শক্তি প্রয়োজন এবং ওই শক্তি শ্বসন থেকে আসে। শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় অপসারিত কার্বন ডাইঅক্সাইড সালোকসংশ্লেষণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ব্যবহৃত হয় এবং কার্বোহাইড্রেট তৈরি হয়। এই প্রস্তুত খাদ্য সমগ্র জীবজগতের জীবন রক্ষা করে। শ্বসন প্রক্রিয়া আমাদের কোষের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রক্রিয়ায় কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে আমাদের শরীরের ভারমাস্য নষ্ট হয় এবং বিভিন্ন রোগ-ব্যাধিতে আমরা আক্রান্ত হয়ে পড়ি।